মহানবির মহান জীবন গল্পসিরাত অন্যরকম
কয়েকদিন ধরে ইয়েমেনী লোকটা মক্কার অলিগে গলিতে উদভ্রান্তের মত ঘুরছেন। পরনে ব্যবসায়ীর পোশাক, চেহারায় বয়সের বলিরেখা স্পষ্ট। কিন্তু অনাহারে আর পেরেশানিতে ভেঙ্গে পড়েছেন খুব। জনে জনে গিয়ে বলছেন, হে মক্কাবাসী! আমি তোমাদের কাছে এসে জুলুমের শিকার হয়েছি। আমার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউই নেই যে আমার পাশে দাঁড়াবে? নাকি তোমাদের এই পবিত্র নগরীতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হয়?! লোকজন ভীড় জমাতে শুরু করে। এই লোকের অভিযোগ মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা আস ইবনে ওয়াইলের বিরুদ্ধে, তাই সাধারণ জনতা ভিতরে ভিতরে ফুঁসলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। ইয়েমেনী এই ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে এসেছিলো মক্কায় বিক্রির উদ্দেশ্যে।
.
ফিজার যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষের দিন ফিকে হতে শুরু করতেই নানান অঞ্চল থেকে সওদাগর আসতে শুরু করেছে মক্কা অভিমুখে। মক্কার বাণিজ্য রুট আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠছে। মক্কার অধিবাসীরাও আশেপাশের এলাকার সাথে বাণিজ্য পুনরায় চালু করেছে। মন্দাভাব কেটে উঠছে। মুহাম্মদও (সঃ) ছোট ছোট ব্যবসা করছেন। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এসব ব্যবসায় তাঁর সাথে আছে সায়েব মাখযুমী।[1] মহল্লায় ভালো ফলাফল পাওয়ার পর আশেপাশের এলাকাতেও তাঁদের অংশীদারিত্বের ব্যবসা ভালো সুনাম কুড়াচ্ছে। উঠতি ব্যবসায়ী হিসেবে মুহাম্মদের এখন লোকমুখে। ঠিক এমন সময়েই সেই ইয়েমেনী ব্যবসায়ীর ঘটনা ঘটলো, যে প্রতারণার অভিযোগ এনেছে মক্কার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আস ইবনে ওয়াইলের বিরুদ্ধে। আস ওই ইয়েমেনীর সব পণ্য কিনে নিলেও মূল্য পরিশোধ করছেনা। সে ভেবেছিল কয়েকদিন গড়িমসি করলে পাত্তা না পেয়ে এই লোক ইয়েমেনে ফিরে যাবে। কিন্তু মক্কার সমমনা তরুণ সমাজ যা বুঝার বুঝে নিল, ইয়েমেনী ব্যবসায়ীর সাহায্যার্থে তাঁরা একটি সার্বজনীন চুক্তির সিদ্ধান্তে পৌঁছল।
.
মক্কার সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ও সচেতন মানুষদের একজন আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআন। তাঁর বাড়িতেই জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। উপস্থিত আছে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সহ তরুণদের অনেকেই। চাচা আবু তালিবের এসেছে মুহাম্মদও। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল, মজলুম যেই হোক তার অধিকার আদায়ে তাঁরা সকলেই সর্বদা সোচ্চার থাকবে। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক যুদ্ধ দেখে মক্কাবাসী বুঝতে পেরেছে, সমাজে ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে যুদ্ধ ও জুলুম থামানো সম্ভব না। জাহেলী সমাজে এমন ইনসাফপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতায় থাকতে পারার বিনিময়ে যদি একপাল গবাদি পশু দিয়ে দিতে হয়, তাই সই।
.
ইয়েমেনের যাবিদ এলাকার সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বিদায় নেয়ার আগে উপস্থিত সবার হাতে চুম্বন করলেন। বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন। বিশেষত মক্কার তরুণ সমাজের প্রতি। তাদের উদ্যোগেই তিনি তার অধিকার ফিরে পেয়েছেন, আস ইবনে ওয়াইল থেকে বুঝে পেয়েছেন পণ্যের মূল্য। সহাস্য সবাই ইয়েমেনীকে বিদায় জানালো। প্রতিশ্রুতি দিল সবসময় মক্কা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকবে। সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে মানুষটি তার উটে চড়ে বসলেন। উটের খুরের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে সামনের মরু প্রান্তরে। সেই আওয়াজ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মক্কার এক নতুন যুগের বার্তাকে। হিলফুল ফুদ্বুলের বার্তা। ইনসাফের নয়া আবাহন।
[1] আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।