মহানবির মহান জীবন গল্পসিরাত অন্যরকম সীরাত
ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের মূর্তিগুলো মক্কার আনাচে-কানাচে সময়ের বিবর্ণ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ কা’বার ভিতরে হলেও সাফা-মারওয়া পাহাড়, আর অন্যান্য টিলাতেও দেবদেবীর মূর্তি শয়তানের ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের সুদীর্ঘ পালাবদলে মানুষের মনেও বদল আসার ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। সামাজিক অবক্ষয় ও জীবনের নৈরাশ্য পৌত্তলিকতার প্রতি মক্কাবাসীর আস্থা নড়বড়ে করে দিয়েছে। হিজাযে বেশ কয়েকজন হানিফ লোক আছেন যারা সবধরনের শিরিক, অন্যায় ও পাপ থেকে দূরে থাকেন। স্বভাবগতভাবে যারা পৌত্তলিকতা আর পাপের প্রতি বিতৃষ্ণ সেরকম মানুষগুলো এই হানিফ লোকদের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করেন আর আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করেন।
.
বন্ধু মুহাম্মদ (সঃ) শাম সফরে যাত্রা করার পর বড্ড একা একা লাগছে আব্দুল্লাহর। বাল্যকাল থেকেই দুজনের সখ্যতা খুবই আন্তরিক। দুজনেই প্রায় সমবয়সী, দুজনের চারিত্রিক মিলও চোখে পড়ার মত। এছাড়া দুজনেই ব্যবসায়ী। ষষ্ঠ পূর্বতন পুরুষে গিয়ে উভয়ের বংশও মিলেছে, সেই হিসেবে আত্মীয়ও বটে। মক্কার সকলেই মুহাম্মদকে আল-আমীন নামে ডাকে। আর এদিকে আব্দুল্লাহকেও সবার কাছে আবু বকর নামে পরিচিত। মক্কাবাসী একজন হানিফ ওয়ারাকা’র কাছে যাচ্ছেন আবু বকর। বয়োজ্যেষ্ঠ এই হানিফ ব্যক্তি তাওরাত-ইনজিলের জ্ঞান রাখেন। লিখতেও জানেন। সঠিক দ্বীন ও সত্য নবীর অপেক্ষায় দিন গুজরান করছেন। অনেক্ষণ নানান বিষয়ে আলাপ হল। ওয়ারাকা সাধারণত বাহিরে যান না, বাহিরের খোঁজখবর তাঁর কাছে আসা মানুষদের কাছে পান। লোকজনও তাঁর কাছে অন্তরের শান্তি নিতে আসে। সময় যাচ্ছে আর গোপনে একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে সত্যকে গ্রহণ করার সাহস নিয়ে।
.
মুহাম্মদের সাথে গতিতে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা মায়সারা। মাঝেই মাঝেই বেশ পিছিয়ে পড়ছে সে। রোদের তীব্রতা মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠছে। সম্ভবত তার বাহনে বাণিজ্যের পণ্য বেশি হওয়ায় গতি ধীর হয়ে আছে, ভাবলো মায়সারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটি দৃশ্য তাকে বেশ অবাক করলো। রোদ বাড়লেই দুটি ছায়া মুহাম্মদের বাহনের উপর নেমে আসছে, কিন্তু আকাশে তিলমাত্র মেঘের আনাগোনা নেই। ছায়াদুটোর গতি তাল মিলিয়ে চলছে। দেখতে দেখতে শামের চৌহদ্দি নজরে এলো। শামের বাজারে সবসময় আগুন ঝরে। কি নেই এখানে? সব ধরণের পণ্যের সম্ভার আর মুনাফাও দ্বিগুণ হয়। আর শামের বাজারগুলোর মধ্যে বসরার পাইকারী বাজার সবচেয়ে উন্নত আর মনোরম। কবিদের আসরও বসে সন্ধ্যায়। বেশ মনোমুগ্ধকর সেইসব জলসা। ফানুসবাতির আলোয় কেমন আলোআঁধারি জাদুর রেণু উড়ে ওখানে। বসরার সিংহদ্বারের সামনে পৌঁছতে ভাবনার রেশ কেটে গেল মায়সারার। দ্রুত নেমে কাজে লেগে গেল। আড়তদার আর পাইকারী সওদাগরদের সাথে আলাপ করতে সেদিকে চলে গেলেন মুহাম্মদ।
.
পণ্যের পসরা সাজিয়ে জিরাতে যাবে মায়সারা ঠিক তখনই দূরে এক পাদ্রীর দিকে নজর গেল তার। পাদ্রী তাকে হাতের ইশারায় ডাকছেন, ঠোটে মৃদু হাসি। এখন দুপুরের ওয়াক্ত, সবাই দুপুরের খাবার আর একটু আরামের খোজের এদিকসেদিক ছড়িয়ে পড়েছে। বাজার সুনসান। অগত্যা ক্লান্তি স্বত্ত্বেও মায়সারা পাদ্রীর দিকে হাঁটা ধরল। কাছে আসতেই সহাস্যে এগিয়ে এলো পাদ্রী মশাই। নিবিড় করে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যেন খুব সংগোপন আলাপচারিতা করতে উন্মুখ হয়ে আছেন। কুশল বিনিময় খুব সংক্ষেপ করলেন তিনি। এরপর দূরে একটি গাছ দেখিয়ে বললেন উনাকে চিনো? কে উনি? তোমার সাথে আসতে দেখেছি। এবার ভালো করে তাকিয়ে মায়সারা দেখতে পেল গাছটির ছায়ায় আবছা দেখা যাচ্ছে মুহাম্মদকে। অনেক দূরে হওয়ায় কেবল অবয়বটাই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এত দূরে এই লোকের চোখ গেল কি করে?!
.
জ্বী, ইনি মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, একজন সজ্জন ও সচ্চরিত্রের লোক, বলেই মায়সারা মুখের ঘাম মুছে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল মুহাম্মদ কি করছে। রহস্যময় হাসি দেখা গেল এবার পাদ্রীর ঠোঁটে। প্রায় ফিসফিস করেই বললেন, এই পর্যন্ত ঐ গাছের নীচে নবী ছাড়া আর কেউ আসন পেতে বসেনি। ব্যাপারটা যখন থেকেই জেনেছি তখন থেকেই আমার নজর এই গাছ থেকে সরেনি। আর আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি আরো যা আলামত দেখছি ইদানিং এতে মনে হয়েছে আখেরী নবীর আবির্ভাব হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এখন তো মনে হচ্ছে আমার ধারণাই ঠিক। এই লোক নবী না হয়ে যায়না! বাকরুদ্ধ মায়সারা পাদ্রীর চেহারায় যেন এইমাত্র শোনা কথাগুলো পড়ার চেষ্টা করতে লাগল, আর তার চোখে ভেসে উঠলো আসার পথে দেখা সেই রহস্যময় জোড়া ছায়া। পাদ্রীর ডান হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মায়সারা চুমু খেল। তার চোখে বিস্ময় এখনও বরফের মত জমে আছে।
.
দুই একদিনের মধ্যেই সব মালামাল কয়েকগুণ মুনাফায় বিক্রি হয়ে গেল। মুহাম্মদের সত্যবাদিতা, সদাচরণ ও নিখুঁত লেনদেন দেখে অভিভূত মায়সারার মাথায় কেবল পাদ্রীর কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। আগামী রাত পূর্ণিমা। পরদিন সকাল হলেই মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে মুহাম্মদ ও মায়সারা। মক্কার জন্য পণ্য কেনা প্রায় শেষ। হাওদার উপর সবকিছু গোছগাছ করে নিচ্ছে মায়সারা। বসরার আঙ্গুর-বেদানা খুব সুস্বাদু। কাজ শেষে আঙ্গুর নিয়ে বসল মায়সারা। সন্ধ্যা হলেই বসরা বাজার নতুন রূপ ধারণ করে। থোকা থোকা প্রদীপের আলোয় দোকানগুলো দেখতে অপার্থিব লাগে। মানুষের ছায়াগুলো নাচতে থাকে দেয়ালে-দেয়ালে। দূর থেকে ভেসে আসে কাব্যচর্চার সুর। ধূপের ধোঁয়ায় ঢেকে যায় বাজারের অলিগলি। মশলার দোকানগুলো আতরের ডিব্বার কাজ করে। ঘ্রাণই মাতাল করা। চোখ বন্ধ করে আঙ্গুর খেতে খেতে এসব কল্পনার চোখে উপভোগ করতে করতেই ক্লান্তিতে মায়সারার চোখ মুদে এলো।
.
ভোরের সূর্য তেতে উঠার আগেই ফিরতি পথ ধরলো মক্কাগামী কাফেলা। পণ্যে ভরা বাহন, থলে ভরা মুনাফা, বুক ভরা আনন্দ আর আশা। বসরার সীমান্ত প্রাচীর পেরিয়ে কাফেলা ছুটলো বন্য মরুর উদ্দেশ্যে। একটু পরেই জনবসতির চিহ্ন ফুরিয়ে যাবে। দুচোখ জুড়ে ধরা দিবে ধূসর বালিয়াড়ি আর টিলা-টক্কর। আদিম মরুর বুক চিরে ধীরে ধীরে দুটি বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে কাফেলা। দূর থেকে একজোড়া চোখ সারাক্ষণ সেঁটে ছিলো তাঁদের উপর। দূর থেকেই সেই চোখের নজর বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছিলো কাফেলাকে। পাদ্রীর দুই নয়নে তখন বিস্ময়ভরা বিদায়ী চাহনি।
মহানবির মহান জীবন সিরিজের বাকী পর্বের লিংক
প্রথম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-q3
দ্বিতীয় পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-q5
তৃতীয় পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-nI
চতুর্থ পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-o2
পঞ্চম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-o7
ষষ্ঠ পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-of
সপ্তম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-oZ
অষ্টম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-pM
নবম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-pX
দশম পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-qb
একাদশ পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-qd
দ্বাদশ পর্ব- https://wp.me/pd9hWS-q0