#মহানবির মহান জীবন #গল্পসিরাত #অন্যরকম সিরাত
মক্কার অদূরে উকায বাজার। প্রতি মৌসুমে এখানে বাণিজ্য মেলা সরগরম হতে শুরু করে। সাজানো পসরার দোকানগুলোতে ভীড় জমতে শুরু করে। আশেপাশের বেদুইন গ্রামগুলো থেকে পাইকারী পণ্য কিনতে আসে সাওদাগরের দল। তাই উকায মেলা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীদেরও আগ্রহের মধ্যবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ব্যবসা নির্বিঘ্ন রাখতে এই মৌসুমে সব ধরণের নাশকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাজারের নিত্য বিকিকিনির উপর ভর করে আরো কয়েক ধরণের ধান্ধাও গড়ে উঠেছে। বাণিজ্য কাফেলাগুলো নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে দরকার হয় দক্ষ ও শক্তিশালী প্রহরার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থকড়ি কামাতে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যাদের হিসেবটাও সোজা। কোন কাফেলার নিরাপত্তার ঠিকাদারি পেতে গোষ্ঠীগুলো মরিয়া হয়ে থাকে। এক গোষ্ঠী কোন কাফেলার নিরাপত্তার কাজ পেয়ে গেলে আরেক গোষ্ঠী তক্কে তক্কে থাকে সেই কাফেলা লুট করে নেয়ার। এ এক আরব্য মাফিয়া গোষ্ঠীর চোরা রাজত্ব। বানিজ্যিক রুটগুলো যাদের মূল চারণভূমি। উকায মেলা এদের উপার্জনের প্রধান ফুরসৎ।
.
রাজকীয় আসনে বসে হুক্কায় টান দিচ্ছে হিরা প্রদেশের সম্রাট নুমান, ক্ষমতাকে সে ব্যবসার মূলধন বলেই বিশ্বাস করে। আরবের যত বাণিজ্যিক কেন্দ্র আছে সবগুলোতেই সে তার ব্যবসার হাত প্রসারিত করতে উন্মুখ হয়ে আছে। তাই তার দরবারে আরবের বাণিজ্যিক রুটের হোমরাচোমরাদের আনাগোনা চলতেই থাকে। বাররাদ কিনানি ও উরওয়ার দিকে তাকিয়ে সে গলা খাকারি দিলো। বাররাদ ও উরওয়া মক্কার বানিজ্যিক রুটের চিরপ্রতিদ্বন্ধি দুই গোষ্ঠীর প্রধান। দুজনেই এসেছে উকায মেলা উপলক্ষ্যে নুমানের নতুন ব্যবসার চুক্তি পেতে। গমগমে গলায় নুমান কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল-
উকায পর্যন্ত আমার সামান পৌঁছতে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা কে দিতে পারবে?
উরওয়া চালাক, সে চুপ থাকল। বাররাদের রক্তে তখনও নতুন ধান্ধা পাওয়ার বারুদ জ্বলছে। নেশাতুর সম্রাটের সামনে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে জানালো-
“কিনানা এলাকার দায়িত্ব আমার হাতেই”। অথচ সে নিজের কিনানি গোত্রের কাছেই নানান অপকর্মের দরুন ফেরারী হয়ে আছে। নুমান রাগ চেপে রেখে বলল- আমি সমস্ত রুটের নিরাপত্তা চাই।
উরওয়া সুযোগটি লুফে নিয়ে বলল- আপনি একটা দলছুট কুকুরকে দিয়ে ব্যবসার নিরাপত্তা খুঁজছেন? আপনি চাইলে আমি কাফেলার দায়িত্ব নিব। সব বেদুইন গোত্রের এলাকা, নজদ-তাহামার সুরক্ষা আমিই দিব।
বাররাদ টিটকারী দিয়ে বলল- তুমি কি কিনানার গ্যারান্টি দিতে পারবে?
দাঁতে দাঁত চেপে উরওয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানালো- বললাম তো, সমস্ত আরব অঞ্চলের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।
.
উকায মেলা নিয়ে কুরাইশের আয়োজকরা আলোচনায় মশগুল। ধূপের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে পড়ন্ত বিকেলের ছায়ায়। হঠাৎ ছায়া ফুঁড়ে একজন দৌড়ে এসে চিৎকার করে জানালো, ইরাকের হিরা প্রদেশের সম্রাট নুমানের বাণিজ্য কাফেলা আক্রান্ত হয়েছে। হত্যা করেছে হাওয়াযিনদের উরওয়া সহ আরো কয়েকজনকে। আর এই নাশকতার যে করেছে সে আর কেউ নয়, কিনান গোত্রের বিতাড়িত দস্যু বাররাদ। দুঃসংবাদ শুনে উপস্থিত সবারই রক্ত হিম হয়ে আসলো। মুর্তির মত ঝিম ধরে বসে আছে, নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে সবাই। এই ঘটনার রেশ ধরে কি ধেয়ে আসতে যাচ্ছে তা বুঝতে আর কারো বাকি নেই। যে গোত্রের সাথে কুরাইশ ও কিনানীদের চিরবৈরিতা সেই ক্বায়স ও হাওয়াযিন এবার সুযোগ পেয়ে গেছে। সম্বিত ফিরতেই একজন বলে উঠলেন, এক্ষুণি আমাদেরকে মক্কায় ফিরে যেতে হবে। কে জানে, হাওয়াযিনরা হয়তো এতক্ষণে আমাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। চকিত সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে যেন অদৃশ্য গুপ্তঘাতকের অস্তিত্ব খুঁজতে চাইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুরাইশিরা প্রস্থান করলো, তখনও ধূপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মিশে যাচ্ছিলো উপরের খেজুর ডালে।
.
নাশকতার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উন্মত্ত হাওয়াযিনরা ছুটছে মক্কার দিকে। অন্যদিকে উকায ফেরত কুরাইশিরা সন্তর্পনে চলছে। নাখলা নামক স্থানে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শোনা গেল। হাওয়াযিনরা বুঝতে পারল এরা কুরাইশি। রক্ত গরম থাকতেই এর বদলা নিতে হবে। অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে কুরাইশদল চারদিকে ছড়িয়ে আক্রমণকারীদের সংঘবদ্ধ শক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলল। যার যার বাহন নিয়ে কোনরকম মক্কায় পৌঁছতে পড়িমরি করে ছুটল। সন্ধ্যা নামতেই কুরাইশি ও কিনানীরা মক্কায় প্রবেশ করতে পারলেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। কিন্তু হাওয়যিন পিছু ছাড়েনি। হিংস্র নেকড়ের ক্ষুধা চড়ে গেছে ওদের মাথায়। হারামের পবিত্রতার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই আক্রমণ অব্যাহত রাখল। একসময় টনক নড়লে আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হলেও, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে গেল, আগামী বছর উকায প্রান্তরে ফায়সালা হবে তরবারির ভাষায়। চরম দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল মক্কার বসতি। মুহাম্মদ তখন ১৫ বছরের কিশোর। তাঁর নবীন মানসপটে তখনও যুদ্ধের ভয়াবহতা বলে কোন স্মৃতি জমা হয়নি। কিন্তু বড়দের চেহারায় সে স্পষ্ট দেখতে পেল সামনের দিনগুলো কি বয়ে আনতে যাচ্ছে।
.
পরেরবছর উকায প্রান্তর, টানটান উত্তেজনা দুই শিবিরে। বাকযুদ্ধেই প্রথম দিন কেটে গেল। উভয় পক্ষ গলার রগ ফুলিয়ে কাব্যের ফলায় জর্জরিত করে চলেছে শত্রুপক্ষকে। পরেরদিন শুরু হল সংঘাত। একজন জনবিচ্ছিন্ন দস্যুর অপরাধের পরিণতিতে হিজাযের সব গোত্র দুইভাগে বিভক্ত হয়ে লড়ছে। স্বজনদের উপরেই ছুড়ছে তীর। দুই দিকেই হতাহত হচ্ছে প্রচুর মানুষ। মক্কার পবিত্রতাকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে নিষিদ্ধ মাসে। মক্কার কিশোররা অসিচালনা আর তীরন্দাজীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বছরজুড়ে। কিন্তু মুহাম্মদ এতদসত্ত্বেও রণক্ষেত্র থেকে দূরে। সে বুঝে গেছে এই যুদ্ধ অন্যায়ের যুদ্ধ। উভয়পক্ষে এক চিলতে সুবুদ্ধি কিংবা শুভবুদ্ধির উদয় হলেও এই বিশাল ক্ষতি থেকে বেঁচে যেত হিজাযের মানুষ। ফিজার ফিজার… এটি অন্যায় এবং কেবল অন্যায়েরই মিথ্যে মহড়া! কয়েকদিনের টানা যুদ্ধের পর আবারো পরবর্তী বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে ফিরল উভয় শিবির।
.
তৃতীয় বছর। উকায প্রান্তরে আবারো মুখোমুখী মক্কা ও তায়েফবাসী। লড়াইয়ের বিভীষিকা শিশু-কিশোরদের মনে কালো দাগ ফেলে চলেছে। মুহাম্মদ শুত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কুড়িয়ে আনছে। কিছু তীরের মাথায় রক্ত লেগে আছে, আপনজনদের রক্ত! এই তীরবাজি একদিন ফুরাবে, রক্তের দাগ মুছে যাবে, কিন্তু অন্তরের ক্ষত কি করে শুকাবে?! কি সেই সূত্র যা মানুষের অন্তরের বিদ্বেষকে নিভাতে পারে? কি সেই বরফকুচি যা হিংসার আগুন নিভাতে পারে?! হেঁচকা টানে কেহজুরগাছে বিঁধে থাকা একটি তীর টানতে টানতে এসব ভাবছে মুহাম্মদ। যথারীতি কয়েকদিনের নৃশংসতা শেষে আবারো পরের বছরের রক্তিম আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ নিজ ডেরায় ফিরে গেল হিংস্র মানুষগুলো।
.
কাবার পবিত্রতা ক্ষুন্ন করেই চলেছে হাওয়াযিন ও বনু ক্বায়স। চতুর্থ বছরেও তারা উসকানি দিয়ে জড়ো হল উকাযে। এবার কুরাইশরাও এর শেষ দেখে ছাড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে উপস্থিত হল। আটদিনের যুদ্ধ ও গত চারবছরের রক্তভারে একসময় উভয় পক্ষেই বিবেক মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো। আল্লাহর অনুগ্রহে এক বয়োবৃদ্ধ কুরাইশির মধ্যে শান্তিচুক্তির প্রস্তাবনার চিন্তা আসল। তিনি উভয় পক্ষকে শান্তিচুক্তির আহ্বান জানালেন। উভয় পক্ষই ক্লান্তির শেষসীমায়। শান্তিচুক্তির প্রস্তাব যেন নিরাপত্তার অমিয় ধারা বর্ষন করল। পরিসমাপ্তি ঘটল ভয়ানক ফিজার যুদ্ধের। বিশ ছুঁই ছুঁই মুহাম্মদ দেখল এই পৃথিবীকে ঐক্যের সূতিকায় গাঁথতে মহাজাগতিক শান্তির বার্তাই প্রয়োজন। মানবতাকে রক্ষা করতে মানব রক্তের পবিত্রতাকে বিশ্বাসে পরিণত করতে হবে। এমন একজন মানুষের আবির্ভাব প্রয়োজন যার ডাকে অকাতরে সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে প্রিয় দাদা আব্দুল মুত্তলিবের চেহারা ভেসে উঠলো মুহাম্মদের চোখে।
পর্ব ৮