আখেরাতের নবী || গল্পসিরাত || অন্যরকম সিরাত ||
রাসূলের সাথে আখেরাতে আমাদের জীবনটা কেমন হবে? আসুন পড়ি ৭ম পর্ব
চোখ ধাঁধানো নূরের প্লাবনে ভাসিয়ে একে একে খুলে যাচ্ছে জান্নাতের প্রধান ফটকগুলো। যার একেকটি পাল্লাই কেবল আরব ভূখণ্ডের সমতুল্য। এক দরজা থেকে আরেক দরজার দুরত্ব চল্লিশ বছরের অশ্বগতির সমান। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ আমলের আধিক্য অনুযায়ী প্রবেশপথ বেঁছে নিচ্ছে। অধিক রোজাপালনকারীরা ‘রাইয়ান’ নামের দরজায় ভিড় করেছে। নিয়মিত সালাত আদায়কারীদের জন্য সব দরজাই উন্মুক্ত। প্রতিটি দরজায় ফেরেশতারা গুনগুনিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেঃ আপনাদের প্রতি সালাম! চিরসুখী হোন; প্রবেশ করুন এই জান্নাতে অনন্তকালের জন্য! সুদীর্ঘ ধৈর্য্যের বিনিময়ে আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হক।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) মানবজাতির সব দরিদ্র মুহাজিরদের সাথে করে ডানের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। সকল নবী রাসূলরাও ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে যিনি প্রথম জান্নাতে পা রাখলেন তিনি আবু বকর (রা)। সবার চেহারা পূর্ণিমা চাঁদের মতো হাস্যজ্জ্বোল। বাকীরা আমল অনুযায়ী সারিবদ্ধ হয়ে প্রবেশ করতে লাগলো। প্রত্যককেই স্বর্ণ-মুক্তার মাল্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হচ্ছে। জান্নাতের চৌকাঠ পেরোতেই অবিশ্বাস্যভাবে সবাই আমূল বদলে যেতে শুরু করলো। রূপে, গুণে, বয়সে, পোশাকে, সৌন্দর্য্যে…
জান্নাতের দরজা পেরোতেই নয়নাভিরাম খিলানের সারি। প্রতিটি মানবসন্তানের দেহ এখন ষাট ফুট দীর্ঘ, মসৃণ ত্বকে নেই কোনো পশম, ইউসুফ (আ) এর সৌন্দর্য্য ঠিকরে পড়ছে তাঁদের ত্রিশোর্ধ সুঠাম দেহ থেকে। কাজল কালো চোখে রাজ্যের বিস্ময়, অপলক তাকিয়ে আছে সামনে। দৃষ্টিজুড়ে হলুদ জাফরানের বিস্তীর্ণ ভূমি। মুক্তা আর ইয়াকুতের নুড়ি-পাথর চমকাচ্ছে সেখানে।
প্রতিটি স্থাপনা স্বর্ণ-রূপার বিপরীতমুখী ইট দিয়ে নির্মিত। আবেশ ছড়ানো সুরভী নিয়ে উড়ছে মেশকের মিহি ধূলো, সেখান থেকেই একের পর এক ফেরেশতা উদয় হচ্ছেন আর পরিবেশন করছেন জান্নাতের সমুদ্রে বেড়ে উঠা অতিকায় মাছের ধূমায়িত কলিজার আপ্যায়ন। জান্নাতীদের প্রথম আতিথেয়তার জন্য হাশরের ময়দানকে পরিণত করা হয়েছে রুটিতে। সেই রুটিও আছে পরিবেশনায়। এই সামান্য নাস্তাতেই বিমোহিত হয়ে পড়েছে জান্নাতের প্রথম কাফেলা।
সাত আসমান ও জমিন ব্যাপৃত জান্নাতে আজ সাজ সাজ রব। এ জান্নাতের বাগানেই বেড়ে উঠা একটি ষাড় এনে জবাই করা হলো। জান্নাতবাসীর মেহমানদারি বলে কথা। দেখতে না দেখতেই সবার জন্যে তৈরি হয়ে গেল মানবেতিহাসের সুস্বাদুতম খাবার। ঝলমলে রেশমি পোশাকে সজ্জিত জান্নাতীরা আয়েশ করে বসেছেন মখমলের উপবেশনে। সেখানেই পরিবেশন করা হচ্ছে রুটি আর গোশত। সাথে আছে ‘তাসনিম’ জলে মেশানো মধুর শরাব। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও জান্নাতীদের চোখ আটকে আছে তাঁদের জন্য অপেক্ষমান আল্লাহর আরশচুম্বি শততল বিশিষ্ট সুরম্য অট্টালিকার বাসস্থানে।
আকস্মিকতার প্রথম ধাক্কা আস্তে আস্তে সয়ে আসছে। সবাই মুখোমুখি উপবেশনে বসে খোশগল্পে মেতে উঠছেন। জাফরানের মাঠজুড়ে কিছুদূর পরপর নক্ষত্রচুম্বি সবুজ ডালপালা ছড়ানো বিথী। এর ছায়া মাড়াতে বোধ করি শতবছরের অশ্বগতিও ব্যর্থ হবে। অদূরেই পাহাড়ের মত দৃষ্টি আড়াল করে আছে স্বর্ণ-রত্নের বুনটে নির্মিত সুরম্য প্রাসাদ সমষ্টি। এর অদ্ভুত সুন্দর গড়ন অতি অকল্পনীয় আদলে দৃষ্টি ভেদ করে চলে গেছে আল্লাহর আরশ পানে।
শততলার ভিতরে গোলকধাঁধার মতো মিশে আছে কোরআনের আয়াত সংখ্যক সহস্রস্তরের নিবাস। কোরআনের হাফেজরা তিয়াওয়াত করতে করতে এসব নিবাসের মালিক হতে থাকবে। আর মুজাহিদরা পুরো একশতলার উত্তরাধিকারী হবেন। একেক তলার দৈর্ঘ্য পৃথিবীর আসমান-জমিন সমান। এর পরিপাটি করে সাজানো কক্ষগুলো থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্বর্ণাভ ঝলক। সর্বোচ্চ স্তরের নাম ফিরদাউস, আরশ দিয়ে যার ছাঁদ নির্মিত হয়েছে। এর সৌন্দর্য্য চোখ দিয়ে ক্ষণিকের বেশি সহ্য করা যায়না!
প্রতিটি প্রাসাদের সাথে আছে ঝুলন্ত বৈঠকখানা, একেবারে স্বচ্ছ কাঁচের বুননে নির্মিত যেন। ভেতর-বাহির প্ৰাঞ্জল দৃশ্যমান। এখানে জান্নাতবাসীরা মেহমানদের সাথে সময় কাটাবে। এটা পাবে কেবল ঐ জান্নাতীরা যারা দুনিয়াতে মানুষকে আপ্যায়ন করতো, অভাবীকে খাওয়াতো, দুঃস্থকে আহার দান করতো। জান্নাতের দিগন্তজুড়ে কিছুদূর পর পর বসানো আছে ষাট মাইল উচ্চতার বিশাল বিশাল মুক্তা সদৃশ তাঁবু, গোলাকার গোটা তাঁবুটাই একদানার ফাঁপা রূপালী মুক্তা। এগুলো জান্নাতীদের প্রমোদ্ঘর; পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে তাঁরা পুনর্মিলিত হবে। একেকটি মুক্তা-তাঁবু এতই বিশাল যে আত্মীয় স্বজনরা আলাদা আলাদা দলে একেক কোণে আড্ডা দিবে। তাঁবুর মালিক ঘুরে ঘুরে তাঁদের সাথে কুশল বিনিময় করবে।
চারদিকের দৃশ্য দেখে দেখে এসব নিয়েই আড্ডা দিচ্ছিলো জান্নাতীরা। হঠাৎ একদল নিষ্পাপ শিশু কোত্থেকে এসে তাঁদের মাঝে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো… খিলখিল করে হাসছে আর লুটোপুটি খাচ্ছে, আনন্দের নতুন এক হিল্লোল ছড়িয়ে পড়লো সবার মাঝে। শিশুদের কান্ড-কসরতে জান্নাতীরা আমোদিত হচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই এই শিশুরা জান্নাতীদের মাঝে তাঁদের ইহকালের শিশুসন্তান ও আত্মীয় স্বজনদের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। এবার হকচকিত হয়ে উঠল জান্নাতীরা। একে অপরকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো আমাদের সেই আত্মীয়রা কোথায় যারা আমাদের মতোই দ্বীন পালন করতো!! কোথায় আমাদের বন্ধুরা? যাদের ছাড়া আমাদের আড্ডাগুলো নিষ্প্রাণ থাকতো?! তাঁদের দেখছিনা কেন?!
নতুন এক হাহাকারে জান্নাতীদের মন হু হু করে কেঁদে উঠলো।
চলবে…